Sunday, August 4, 2019






কবি কালীকৃষ্ণ গুহ অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলায় 1944 সালের 12ই ফেব্রুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন।তিনি বাংলা কবিতার পটভূমিতে স্বয়ং একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি চান কবিতার ভাষা হবে গদ্যের ভাষা। কবিতা তাঁর কাছে নিষিদ্ধ  মায়াময়, নিগূঢ় কোন শিল্পকলা নয়,কোন মাথা ফাটাফাটি ব্যপার নয়,গর্বিত হওয়ার মতো কোন পুণ্যার্থ নয়।তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ষাটের দশকের প্রথম দিকে "ক্রান্তদর্শী"। "বাক্" এই সংখ্যা কবি কালীকৃষ্ণ গুহকে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে তাঁর দশটি কবিতা ও তাঁকে নিয়ে কবি গৌতম বসু,কবি গৌতম চৌধুরি ও কবি শুভাশিষ ভাদুড়ির লেখা তিনটি প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে।








গদ্যকার কালীকৃষ্ণ গুহ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
গৌতম বসু

                      
‘পথচ্যুত উল্কার চিতাগ্নি’ শীর্ষক নিবন্ধে শ্রী কালীকৃষ্ণ গুহ তাঁর পূর্বগামী লেখক-সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-র প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ-এর কবিতা ও  চিন্তার জগৎ ধ্রুপদীলক্ষণাক্রান্ত, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র এক সার্থক উত্তরসাধক ;  সুধীন্দ্রনাথ তাঁর ধর্মানুরাগী পিতার দম আটকে-যাওয়া পৃথিবী থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তি আস্বাদন করেছিলেন  এইধরনের বহুচর্চিত  ভাবনাসূত্র থেকে শুরু করলেও, কালীকৃষ্ণ গুহ তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য-মূল্যায়নকে আরও বহুদূর প্রলম্বিত করেছেন, পুরানো প্রশ্নগুলি নিজের কাব্যপাঠের আলোকে নতুন ক’রে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
       অধুনা, সুধীন্দ্রনাথ ততটা অনালোচিত নন, যতটা তিনি অপঠিত । নানা কারণে তা   ঘটে থাকতে পারে ; এটি তাঁর লেখা ঘিরে অনভিপ্রেত বিস্মৃতির পূর্বাবস্থা হতে পারে, হতে পারে বাঙালীর প্রাণবায়ু সঙ্কোচনের একটা সাময়িক পর্বের মধ্য দিয়ে চলেছে ব’লে তরুণ পাঠক সমাজ তাঁর কবিতার বই ও গদ্য গ্রন্থগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এমন কি এমনও হওয়া অসম্ভব নয় যে, তাঁর লেখার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে, তিনি আবেদন হারাতে শুরু করেছেন ।  কালীকৃষ্ণ গুহ , তাঁর স্বভাব অনুসারে, এ-প্রসঙ্গে উচ্চস্বরে কিছু না-বললেও সুধীন্দ্রনাথ-এর প্রতি তাঁর পক্ষপাত খুব স্পষ্ট,সুধীন্দ্রনাথ-এর অটল অবস্থান সম্পর্কে তাঁর বিন্দুমাত্র সংশয় নেই ।  তাঁর আলোচনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে ।
৷৷    ৷৷
        প্রথমেই, সুধীন্দ্রনাথ-এর লেখার স্বল্পতার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে আলোচক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন : ‘কিছু পাবার নেই ব’লে না–পাওয়ার মুক্তি । দীর্ঘ এক আত্মজিজ্ঞাসার পথ পরিক্রমণ করার পর না-পাওয়ার বা শুধু ‘না’  উত্তর পাওয়ায় মুক্তি  দীর্ঘ জ্ঞান-অন্বেষণের পর ‘না’ এসে মুক্তি বা সমাপ্তি । এই হল ভাবুক বা দর্শনপথিক  সুধীন্দ্রনাথের অবস্থান, যিনি বলার মতো কথা না জমলে কিছু বলেননি, নিরন্তর লিখে যাবার জন্য  লেখেননি কিছু।’ (‘কালীকৃষ্ণ গুহ-এর গদ্যসংগ্রহ’, পৃষ্ঠা ৫১) আলোচক অনুমান করেছেন সুধীন্দ্রনাথ–এর এই নীরবতা ছিল আত্মপ্রশ্নে জর্জরিত, এবং ‘একটা অনুধ্যানকে সুস্থির রাখার জন্য’ এই নীরবতা ‘অনতিক্রম্য ছিল তাঁর জীবনে’ । ‘অনুধ্যানকে সুস্থির রাখার  জন্য  নীরবতারক্ষার প্রয়োজনীয়তা সঙ্ক্রান্ত মন্তব্যটি আমরা সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারলাম না, অনুমান করছি , আলোচক বলতে চাইছেন, সুধীন্দ্রনাথ-এর জীবনে বলার মতো কথা ফুরিয়ে এসেছিল ।  আলোচকের মন্তব্যটি ২০০২ খ্রিস্টাব্দের,এবং তা আজও ঈষৎ কর্কশ শোনালেও, মানতেই হয়, তাঁর মত অভ্রান্ত । বস্তুত, এই মন্তব্যের অল্পকাল পূর্বেই সুধীন্দ্রনাথ-এর প্রথম প্রামাণিক জীবনী (‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’ : অমিয় দেব) প্রকাশিত হয়ে গেছে, যেখানে ২৮.০২.১৯৪৬-এ  বুদ্ধদেব বসু-কে লেখা এই চিঠি উদ্ধার করা হয়েছে :
‘ আমার রেডিও বক্তৃতা আপনার ভালো লেগেছে জেনে কতটা উৎসাহিত ও উল্লসিত হয়েছি তা লিখে বোঝানো শক্ত । তাহলেও  বক্তৃতাটা  মোটেও সুলিখিত নয় । তার সময় ছিলো না ; শেষ দিনে রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে কোনোমতে সেটা শেষ করেছিলুম প্রতিশ্রুতিরক্ষার জন্যে । পাঁচ বছর বাংলা লিখিনি ...’  
সুধীন্দ্রনাথ-এর লেখার ধারাবাহিকতা চূর্ণ হওয়ার পিছনে গভীর কোনো দার্শনিক কারণ থাকা সম্ভব, যেমন কালীকৃষ্ণ গুহ লিখেছেন, আবার এমনও হতে পারে ‘উত্তরফাল্গুনী’ (প্রথম প্রকাশ ১৩৪৭ /১৯৪০) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ভাঙন, এর জন্য আংশিক দায়ী ।  সাহিত্য রচনার জন্য ন্যূনতম যে প্রসন্নতা প্রয়োজন তা সাময়িক ভাবে তিনি হারিয়েছিলেন । অনেকের লেখক-জীবনে গ্রন্থপ্রকাশের ধারাবাহিকতা না-হলেও রচনার ধারাবাহিকতা থাকে, অনেকের জীবনে তা নানা ঝড়-ঝাপটায় ছিঁড়ে যায়, যেমন আমরা সুধীন্দ্রনাথ-এর ক্ষেত্রে দেখছি, কিন্তু কেবল এই দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতার মূল্যায়ন করা অতিবিপজ্জনক এক  প্রবণতা । কালীকৃষ্ণ গুহ খুব ন্যায়সঙ্গত ভাবেই সুধীন্দ্রনাথ-এর জন্য উচ্চস্থান সংরক্ষণ করেছেন, তাঁর ভাষ্য অনুসারে, প্রবহমান এক ‘অনুধ্যান’-এর উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন ।  
        আপাতদৃষ্টিতে, সাহিত্য থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়লেও, সুধীন্দ্রনাথ যে  এক মুহূর্তের জন্যও, এক ছত্র কবিতা ভুলতে পারেন নি, তার নানা চিহ্ন ছড়িয়ে আছে তাঁর জীবনে। তাঁর প্রথম প্রবন্ধ সঙ্কলন প্রকাশিত ১৩৪৫ / ১৯৩৮–এ ; এর দুই দশক পরে সিগনেট প্রেস (দিলীপকুমার গুপ্ত) কর্তৃক প্রকাশিত দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণের জন্য (প্রথম প্রকাশ : ১৩৬৪/ ১৯৫৭) লিখিত ‘পুনশ্চ’ শিরোনামের একটি মর্মস্পর্শী রচনা পাঠ ক’রে আমরা আশ্বস্ত হই : অকালমৃত্যুর মাত্র চার বছর পূর্বেও তিনি কবির ‘নর্ম, কর্ম  ও মর্মের একীভাব’কে  এবং ‘শ্রেয়োবোধ’কে উচ্চতম আদর্শরূপে ধার্য করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘...আমার জন্মভূমিকে আমি ভালোবাসি ব’লেই, আমাদের জীবনযাত্রায় শ্রেয়োবোধের সার্বত্রিক অভাব আমার কাছে অত্যন্ত শোচনীয় ঠেকে।’ কোনও  অলৌকিক  উপায়ে আজকের বাঙালীসমাজের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ-এর যোগাযোগ ঘটে গেলে তাঁকে যে নিন্দাবর্ষণের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণ ক’রে নিতে হত, সে-বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই । তদুপরি, তাঁর সমাজসচেতনতার যে ভ্রান্ত চিত্র আমাদের সামনে সাধারণত ফুটে ওঠে, তা একজন তাত্ত্বিকের, একজন  দূরবর্তী দর্শকের; ততটা  নির্লিপ্ত তিনি থাকতে পারেন নি, এবং এখানেও তাঁর সতর্কবাণী উপেক্ষিত রয়ে গেছে ।

৷৷    ৷৷
 দ্বিতীয়ত, সুধীন্দ্রনাথ-এর রচনায় এক কূটাভাসের দিকে আলোচক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । ‘আমার কাব্যজিজ্ঞাসায় আধার আধেয়ের অগ্রগণ্য’, প্রবাদে উত্তীর্ণ হওয়া সুধীন্দ্রনাথ-এর উক্তি আরও একবার উল্লেখ ক’রে কালীকৃষ্ণ গুহ লিখছেন (‘কালীকৃষ্ণ গুহ-এর গদ্যসংগ্রহ’, পৃষ্ঠা ৫২), ‘কিন্তু অবাক লাগতে পারে ভাবতে যে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা স্পষ্টতই আধেয়-শাসিত, বক্তব্যপ্রধান বা বক্তব্যনির্ভর।’ সৌভাগ্যবশত, এখানে কোনও অচলাবস্থার  সৃষ্টি  হয় নি, কারণ, আলোচক তাঁর পাঠ থেকেই একটি সমাধানসূত্রের সন্ধান পেয়েছেন, আমাদের জানাচ্ছেন যে, সুধীন্দ্রনাথ আধারকে গুরুত্ব দিয়েছেন ব’লেই ‘তাঁর আর্তি বিরহ আত্মজিজ্ঞাসা  এবং নিঃসঙ্গের অনুধ্যান আজও আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।’
          আলোচকের এই বার্তা অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু এইটুকু কথা সেরে নিলেই আমাদের প্রয়োজন ফুরোচ্ছে কি না, সে এক স্বতন্ত্র প্রশ্ন । সুধীন্দ্রনাথ কোন্‌ আধার নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন, ধ্রুপদী না রোম্যানন্টিক, এই মূল প্রশ্নটিই আজও অমীমাংসিত। তাঁকে একজন ধ্রুপদী কবি রূপে আখ্যায়িত করার অন্যতম প্রধান বাধা এসেছিল বুদ্ধদেব বসু-র পক্ষ থেকে, যিনি প্রত্যয়ের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ-কে রোম্যানন্টিক গোষ্ঠীতে অন্তর্গত করেছিলেন । এতগুলি বছর পেরিয়ে আসার পরেও বুদ্ধদেব বসু-র যুক্তিশৃঙ্খলা খণ্ডিত হয়েছে, এমন খবর আমাদের কাছে নেই । আমরা তাঁকে পাশ কাটাবার চেষ্টা ক’রে যদি বলি যে, সুধীন্দ্রনাথ-এর বাইরের চেহারাটি ধ্রুপদীলক্ষণাক্রান্ত, কিন্তু অন্তরে তিনি একজন রোম্যানন্টিকের কোমল হৃদয় ধারণ করতেন, তা হলে নতুন ও জটিলতর সমস্যাগুচ্ছ  ভেসে উঠবে। সুধীন্দ্রনাথ-এর ‘আত্মজিজ্ঞাসা’র প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেও নানাবিধ প্রশ্ন উঠতে পারে, কারণ, আদ্যন্ত তিনি একজন আত্মবিশ্বাসী লেখক, সংশয়ের অনিশ্চিত ক্ষেত্রগুলি কখনওই তাঁর কবিতায় স্থান পায় নি। সবার নেপথ্যে তিনি প্রথমেই সংশয়গুলি দূর করেছেন, অন্তত দু’টি পরস্পরবিরোধী মত তৈরি না-হওয়া পর্যন্ত নিজেকে প্রকাশই করেন নি । বস্তুত, এটিই তাঁর মনীষার অনন্য রূপ, নিজেকেই নিজের প্রতিপক্ষজ্ঞানে অবিরাম শেলবর্ষণ ! তদুপরি, রীতি কাব্যের আত্মা, এই বাক্যটি যদি আজও মিথ্যা প্রমাণিত না হয়ে থাকে, তা হলে আধেয়ের শেষ কোথায় এবং কোথায়ই-বা আধারের আরম্ভ, তা নিয়ে নতুন ক’রে আমাদের ভাবতে হবে । যতদিন, নিজেদের বিচারবুদ্ধি অনুসারে, প্রাথমিক স্তরের জটগুলি আমরা  ছাড়িয়ে নিতে না-পারছি, ততদিন, কূটাভাস রয়ে যাবে অক্ষত ।   





জামতলা
এইসব কথা থেকে দূরে
চলে যেতে হবে একদিন
এই কথা ভাবি মাঝে মাঝে
সূর্যালোক হয়েছে বিলীন।
সরলতা, তুমি ঘর বাঁধো
আমাদের মর্মে, কবিতায়
বিচ্ছেদের কথা যেন থাকে
বিস্মৃতির কালের ধারায়।
জটিল হয়েছে বোঝাপড়া
জটিলতা ঘিরে অস্তাচল –
এখানে দাঁড়াই কিছুক্ষণ
ব্যর্থতাও বস্তুত সরল।
অনেক কথার ভার নিয়ে
পথে পথে ঘোরে ফেরিঅলা –
কোনদিকে তার পথ গেছে?
পথের অনন্তে জামতলা।

পলাশ

কত যে পলাশ ফোটে, টের পাই।
পলাশের দিকে যাওয়া মানে অনন্ত গ্রীষ্মের দিকে চলে যাওয়া।
তবু ভাবি পলাশের স্তব্ধতার দিকে যাওয়া যাবে---
পলাশের দিগন্তের দিকে যাওয়া যাবে একদিন।
প্রতিটি যাওয়ার আছে অবসাদ, ঘুম, বিচ্ছিন্নতা
প্রতিটি যাওয়ার মর্মে পরিচয়হীনতা রয়েছে, তার পাশে
পলাশের নিজস্ব নিয়ম।
যাওয়া-না-যাওয়ার ব্যবধানে কত যে পলাশ ঝরে যায়।


গ্রহণ-বর্জন

অনেক রাত হলো
অনেক পুণ্য –
জানি এ-অর্জন
বহু প্রতীক্ষার
বলি না কোনো কথা
গহন সময়ের অন্তরীক্ষে
এ এক ভিক্ষা।
রাত্রি বহমান
সকলই তুচ্ছ
গ্রহণ-বর্জন
নশ্বরের ঘুম
ঈশ্বরীয় জাগা
সকলই খেলা শুধু
বাঁচাই শেষ কথা
আনত ফাল্গুন।
'অনেক রাত হল’
প্রাচীন কন্ঠ


উৎসবের দিন 

অনেক দূরের পথ 
দু'পাশে ধানখেত বাবলা গাছের সারি পুকুর বটগাছ 
তুমি এগিয়ে চলেছ।
শরৎকাল; 
অগণিত কাশফুল দেখে তুমি ভাবছ গতজন্মের কথা।
যারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসে না
তাদের কথা ভাবছ তুমি। 
তারা কোথায় যায় !
তুমি নিজেও ফিরে আসতে চাও না আর। 
সামনেই উৎসবের দিন...









ব্যক্তিকে মুছিয়া জাগিয়া উঠা এক ধারণার গৌরব
গৌতম চৌধুরী



আপন ভাষাচৌহদ্দির বাহিরে জন্মানো একটি শিশুকে হামেশা যে-পরিবেশের মোকাবিলা করিতে করিতে সাবালক হইতে হয়, তাহাতে ভাষার প্রশ্নে আপোশ না করিয়াসে থাকিতে পারে না। কারণ, গরজ বড় বালাই। ইহার পরেও যদি কোনও দলছুট বিস্ময়বালক বা বালিকা আপন ভাষাটিকে মর্মে লালন করিতে চায়, প্রতিকূল বাতাসের বিরুদ্ধে নৃত্যরত সেই মায়াবী মোমশিখাটিকে বহুদূর দিগন্ত পার করিয়া বহন করিয়া লইয়া যাইতে চায়, তাহার দীর্ঘ ও জটিল সংগ্রাম এক অভাবিত সঞ্চারপথের জন্ম দেয়। নানান বিচিত্র ও বিসদৃশ অভিজ্ঞতা, নানান দুর্জ্ঞেয় আত্ম-আবিষ্কার, পলে পলে যে-ভাষ্য রচনা করে, তাহা দুনিয়ার সকল ভাষাশিক্ষার্থীর কাছেই কিছু না কিছু বার্তা পাঠায়।
     কোনও কোনও কবির ভবিতব্যও বুঝি এইরকম। কবিজীবনের জন্মকাল যাঁহাদের অনুকূল নয়। যাঁহাদের উন্মেষপর্বের উপর বিপরীতমনস্ক এক সমসময়সর্বাগ্রাসী ছায়া ফেলিয়া তাঁহাদের স্বভাবধর্মকেকেবলই প্রতিহত করিবার চেষ্টা লয়। কবিও নাছোড় সাঁতারুর মতো, কখনও মাথার উপর দিয়া ঢেউকে চলিয়া যাইতে দিয়া, কখনও কিছু নাকানি চুবানি খাইয়া, কখনও অসম সাহসিক উলটা সাঁতারে, এক দীর্ঘ জলযাপনের ভিতর দিয়া, আপন তটভূমিতে আসিয়া পৌঁছান। বিস্ময়ে আমাদের মাথা নত হইতে কিছু দেরি হয় মাত্র। কিন্তু কবির মহিমা তাহাতে বিন্দুমাত্র খাটো হয় না।আমাদের সৌভাগ্য এই যে, আমাদের জীবৎকালে, এমনই একজন কবির দৃষ্টান্ত আমরা প্রায় চোখের সমুখেই দেখিলাম, যিনি এক শান্ত অঙ্গীকারে দীর্ঘ কবিতাজীবনের ধারাবাহিক প্রবর্তনায় সময়ের বিপ্রতীপ স্রোতকে হেলায় হারাইলেন। তিনি, আমাদের সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় অগ্রজ, কবিকালীকৃষ্ণ গুহ।
     কেজো ইংরেজিতে ‘অড ম্যান আউট’ বলিয়া যে একটি লব্জ আছে, বিগত শতকের ৬০দশকের মাঝামাঝি হইতে ৭০দশকের প্রথম ২/১ বছরের মান্য কাব্যভাষার প্রেক্ষিতে কালীকৃষ্ণের সেকালীন শান্ত ও দূরান্বয়ী উক্তিগুলি নিঃসন্দেহে তাঁহাকে সেই বিসদৃশ জন হিসাবে দাগিয়াছে, যাহাতে তিনি মহাজনি ফর্দ হইতে নিষ্ক্রান্ত হন। তদুপরি, আলোকিত কবিনায়কদের দ্বারা পাপোশে গড়াগড়ি খাওয়া রবীন্দ্রনাথের প্রতিধ্বনি তখনও তাঁহার কণ্ঠে ইতস্তত বিচ্ছুরিতইহা হইতে বড় পাপ আর কিছু হইতে পারে না –


. দারুণ ঝড়ের মধ্যে তোমার সঙ্গে দেখা
. এ পথ দিয়ে পথিক যাবেন
. অন্ধ তিমিরের মধ্যে একটি প্রার্থনা যেন কেঁপে ওঠে
. এবার আমার কলুষ ধুইয়ে দাও
. আমারও রয়েছে অসীম যাত্রার পথ, রৌদ্র, আদিগন্ত ম্লান আলো
 

প্রিয় পাঠিকা প্রিয় পাঠক, আশা করি এমন আন্দাজ করিতেছেন না যে, এই সামান্য কয়টি কবিতাংশ দিয়াআমরা ফয়সালা করিতে চাহিতেছি, কালীকৃষ্ণের প্রারম্ভিক লিখন কিছু ঘোর রাবীন্দ্রিক ছিল। বরং, বলিতে কি, সময়োচিত (বয়সোচিত নয়) ‘দীর্ঘ ঘুম, তিমির-প্রোথিত ঘুম, মৃত্যু’ তাঁহাকে হাতছানি দিয়াছে। সেই অন্ধকারেরই সম্প্রসারণে তিনি আরও টের পাইয়াছেন –‘রুক্ষ ঝাউবনে হাওয়া লাগে, ব্যক্তির অন্ধকার মেশে রৌদ্রে অথবা শীতে, শতাব্দীর দীর্ণ অন্ধকারে’ পঙ্‌ক্তিগুলি, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত কবির নির্বাসন নাম ডাকনাম  কবিতাবহি হইতে সংগৃহীত। দেখিতে পাই, এই অন্ধকার এই অন্ধতা এই রাত্রি এই স্তব্ধতা এই মৃত্যুবোধ, কবিকে প্রায় আরও ২দশক ধরিয়া আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে –
. এই মধ্যরাত্রে আমি মানবিকভাবে এই মাথা রাখি নীল বিছানায়। পাশে জল, মৃত্যুবোধ, ঘড়ি...    – গীতিকবিতার পাশে / একবছরের সামান্য কবিতা, প্র. ১৯৮১

. স্মৃতিফলকের পাশে যে স্তব্ধতা রয়েছে, যে স্থবিরতা, যে/ অবলুপ্ত সময়/ তার কাছে যেতে হবে আমাকে।– গ্রীষ্মের দুপুর /হস্টেল থেকে লেখা কবিতা, প্র. ১৯৮৪

. ব্যক্তির অন্ধকার এসে বারবার ছুঁয়ে দেয় এই মাটি, ঘাস।– দৈত্যের পোশাক /হে নিদ্রাহীন, প্র. ১৯৮৮

. এ জীবন নক্ষত্রের/ অতি স্থির পথে যেতে গিয়ে কালো হয়ে/ ফেরে;   – অসুখ / পিতামহ, খোয়াইয়ে এসেছি, প্র. ১৯৯০

. তিমির রচিত হয় বিশুদ্ধ ব্যক্তির;/ প্রেত-তাড়িতের মতো সে জাগে ধোঁয়ার মধ্যে অবশেষে, একা–তোমার প্রবাহ, চৈত্রমাস, প্র. ১৯৯১

৬. প্রতিটি যাওয়ার আছে অবসাদ, ঘুম, বিচ্ছিন্নতা – পলাশ / অন্ধত্বের প্রশ্নে জড়িত, প্র. ১৯৯১ 


বস্তুত এইসব কবিতা যখন রচিত হইতেছিল, তাহার খানিক পূর্বেই, বু.ব. কর্তৃক প্রচারিত আধুনিকতা বাংলায় ভালোমতো পত্তনি পাইয়া গিয়াছে। তাঁহারই ঘটকতায় কেবলই আছড়াইয়া পড়িয়াছে পশ্চিমী মসিহাদের একের পর এক নাম। সেই লহর হইতে খাদ্যপ্রাণ সংগ্রহ ছাড়া তরুণ কবির উপায় কী? কিন্তু অন্তর্গঠনের বিভ্রাটের ফলে, যাহাকে আমাদের অনেক দোস্ত কহিবেন গ্রহের ফের, কালীকৃষ্ণের ওইসব মহাপ্রাণ খাদ্য ধর্মে সহিতেছিল না। গলায় কাঁটা কেবলই খচখচ করিতে ছিলসেইসব মহান ‘দ্রষ্টা’দের ঘৃণা ও ক্লিন্নতার জগৎ কেবলই হাতছানি দেয়। আর, হৃদয় তবু চায় সেই স্বতপ্রভ নরকের উদ্ভাসগুলি পার হইয়া যাইতে –
 

১. শুধু মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বোদলেয়রের মুখ,/ র‍্যাঁবোর মুখ, আর তাদের নরক। - গ্রীষ্মের দুপুর, হস্টেল থেকে লেখা কবিতা, প্র. ১৯৮৪

২. ঘৃণার ভিতর থেকে তুমি কথা বলেছিলে, আর স্মৃতিফলকের জন্য/ লিখে রেখেছিলে ছোট একটি কবিতা/ তারপর, দীর্ঘদিন পর, এক গ্রীষ্মের দুপুরে তুমি দেখতে পেয়েছ/ তোমার কবিতা/ ঘৃণা আর মৃতদেহ অতিক্রম করে চলে আসতে চায়... – ঐ/

এমন কি, যে-রাত্রি-অন্ধতা-মৃত্যুর বোধ কবিকে দীর্ঘদিন আচ্ছন্ন করিয়া থাকে, তাহাও যেন ভিতরে ভিতরে এক অস্বস্তির কারণ হইয়া বহিয়া চলে। কোথাও যেন মৃদুতম অপরাধী করিয়া তুলে –
রাত্রির বিষয়ে আমি কবিতা লিখেছি, তাই ক্ষমা 
অন্ধতা বিষয়ে আমি কবিতা লিখেছি, তাই ক্ষমা
মৃত্যুর বিষয়ে আমি কবিতা লিখেছি, তাই ক্ষমা
কিন্তু কার কাছে ক্ষমা চাইব? কীভাবে চাইব?– আকাশে তাকিয়ে / একবছরের সামান্য কবিতা

আধুনিকতা লইয়া এই উচাটনের কথা, চাপের কথা, কবি নিজেই এক নির্মোহ ভঙ্গিতে উল্লেখ করিয়াছেন তাঁহার শ্রেষ্ঠ কবিতা-র ভূমিকায়–
গোপন একটা ভয় নিয়ে আমাদের কবিতা লেখা শুরু হয়েছিল চার দশক আগে। কবিতা যথেষ্ট ‘আধুনিক’ হচ্ছে কিনা এই প্রশ্ন থেকে – সময়ের এক শাস্ত্রপাঠ থেকে – ভয়। (২২ জুন ২০০৩)


২.
দুনিয়াকে দেখিবার তরিকা যাহাই হউক, মতবাদ নির্বিশেষে কবিতানাগরিকরা একথা প্রায় মান্য করেন যে, কবিতায় লিপ্ত থাকিবার কালে সেই সৃজনক্রিয়া স্বয়ং, কবিকে আখের ইস্তক চালাইয়া লইয়া যায়, কবিতাটির রাহাখরচের বিলকুল বন্দোবস্ত করেতাই বলিয়া কবির বোধবুদ্ধি যে ইস্তফা দিয়া বসিয়া থাকে, তাহা নয়। তাহা এক প্রচ্ছন্ন আত্মসমালোচক ও বিশ্লেষক বন্ধুর অনপনেয় ছায়ার মতো নিঃশব্দে তাঁহার পিছনে পড়িয়া থাকে। কখনও কখনও কবির সঞ্চারপথটিকে আলতো মোচড়ে নিয়ন্ত্রিত করিবার প্রয়াস লয়। বহু প্রতিভাবান কবিই অবশ্য এই ইশারাটিকে আমলে লইলেও সেকথা চাপিয়া যান। তাঁহারা কবিতা ও স্বজ্ঞাকে আলাহিদা কামরায় পুরিয়া রাখেন। ভাবেন, সব কথা সবখানে ফাঁস করিতে নাই। এইদিক দিয়া কালীকৃষ্ণ সরলতার উপর ভরসা রাখেন। কবিতা লইয়া তাঁহার সংকট ও উপলব্ধিগুলি তিনি কবিতা হইতে গুম করেন না। তাই, স্বজ্ঞার উস্কানিগুলি, পরামর্শগুলি, ধীর ও মন্থর গতিতে কীভাবেতাঁহার উপর ক্রিয়াশীল থাকিয়াছে, আমরা পাঠকরাও তাহা জানিতে পারি।  জানিতে পারি, ‘সময়ের... শাস্ত্রপাঠ’ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবার আকুতিগুলি কীভাবে তাঁহাকে শৈল্পিক উত্তরণের পথে লইয়া গিয়াছে যেমন, আমরা সহজেই দেখিতে পাই, শুরুতে শুরুতেই কালীকৃষ্ণ একবার অনুভব করিয়াছিলেন –‘দীর্ঘকবিতা আমার হাতে বারবার ভাঙা-ছন্দে লিরিক হয়ে ফিরে আসে’ (একটি লিরিক/ নির্বাসন নাম ডাকনাম)যেমন দেখিতে পাই, হস্টেল থেকে লেখা কবিতা-র কালে তিনি খোঁজখবর চালাইতেছেন – ১. ‘কীভাবে আরও সহজ হয়ে আসবে কবিতা’, ২. ‘কার্তিকের মাঠ, কবিতা কি বস্তুনিষ্ঠ হবে’, ৩.’ ভাষা আনো – স্তব্ধতার ভাষা’যেমন দেখিতে পাই, কবিতাজীবনের প্রায় আড়াই দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর পিতামহ, খোয়াইয়ে এসেছি গ্রন্থে আসিয়াবিধিবদ্ধ মিশ্রবৃত্তেতিনি বেশ কিছু অমিল চতুর্দশপদী লিখিয়া ফেলিলেন। এমন এক সংগীতকে স্পর্শ করিতে চাহিলেন, যাহা ‘বাজে মর্মান্তিক, যেন এক/ বেদনার স্বর ধ্বংস করে দেবে সব/ নাগরিক কল্পনার ভান’ (অস্তিবাদী/ )দেখিতে পাই, হয়তো বা সেই ‘নাগরিক কল্পনার ভান’হইতে গ্রেফতারি এড়াইবার মানসে কবির উপর নাজেল হইতেছে এমন মোক্ষম এক আত্ম-প্রত্যাদেশ –
সমস্ত ক্লান্তি এবং অনুশাসনের গল্প বলা শেষ হয়েছে। একটা পর্ব শেষ। এরপর দ্বিতীয় পর্ব। চলো, হাঁটি। মাথার উপরে নক্ষত্রলোক – ভাষাও অন্ধকার হয়ে এল...    – ঝাউগাছ /
       
সেই পর্বান্তরের উদ্‌যাপনে অতঃপর ‘ভাঙা-ছন্দে লিরিক’-এর বদলে আমরা একটি মিশ্রবৃত্ত-আশ্রয়ী দীর্ঘকবিতা পাইলাম। সেই অত্যাশ্চর্য রচনাটির নামতোমার প্রবাহ, চৈত্রমাস অত্যাশ্চর্য এই জন্য যে, এ যাবৎ স্কেচবহির পাতায় কালি ও কলমে ছবি আঁকিয়া চলা শিল্পীটি সহসা যেন কোন্‌ জাদুমন্ত্রবলে দিগন্তের বুকে এক বিপুল দেওয়ালচিত্র আঁকিয়া ফেলিলেন। আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান-স্মৃতি-অনুভূতি মোতাবেক, বাংলাভাষার একটি অন্যতম অবশ্যপাঠ্য কবিতা এইটি। ইতিহাস, পুরাণ, সমাজবাস্তবতা, প্রণয়, যৌনতা ঘিরিয়া ঘনাইয়া উঠা আত্মপ্রশ্নরাশির তরঙ্গমালা এক ধ্রুপদী সাংগীতিক বিন্যাসের মতো ইহার স্তবকে স্তবকে বিচ্ছুরিত। জাদুমন্ত্র যদি কিছু থাকে, তাহা স্ফুরিতহইয়াছিল তাঁহার নিজেরই আত্মপরিক্রমার অভিজ্ঞায়।একদা আশঙ্কা ছিল –‘তবু ভয় হয়, একদিন প্রকৃত উন্মাদ হয়ে যাব’ (ভয় ১/ হে নিদ্রাহীন)আজশুনা যায় সেই প্রকৃত উন্মাদনাকে স্পর্শ করিয়া তাহাকে অতিক্রম করিবার প্রশান্ত হলফ–‘হয়তো কবির কাজ উন্মাদ-না-হবার সঙ্কল্প ধরে রাখা’ব্যক্তির যে-তিমির ইতিপূর্বে বারংবার রচিত হইয়াছে, আজ সেই ব্যক্তির তিমির তার ভাষা খুঁজে পায় অতঃপরকিন্তু সেই ‘ভাষাও কখন যেন অন্ধকার হয়ে আসে’আর, সেই মহতী তমসার ভিতর দিয়া অবশেষে এমনই এক নৈর্ব্যক্তিক অনুভব বাজিয়া উঠে –
ব্যক্তি মুছে গিয়ে ধারণার জন্ম হোক আজ
সব মোহ থেকে মিথ্যা থেকে উন্মাদনা থেকে সত্য জন্ম নিক
সে’সত্য যা কাকের ডাকের মতো – স্থির, রিক্ত, সংগীত-বর্জিত

ব্যক্তি অবশ্য সহসা মুছিয়া যায় না। তবে নানাবিধ ধারণার জন্ম হইতে থাকে। যেমন ‘এই গ্রহ মহাজগতের মধ্যে একা নয়’বা ‘প্রত্যেকটি রাস্তাই অন্ধত্বের প্রশ্নে জড়িত’বা ‘জামপাতা ছুঁয়ে দেখি পরিচয়হীন এক পৃথিবীর দিকে তার যাওয়া’বা ‘এই মরুভূমির শহরে তুমি এক বজ্রাহত পঙ্গু আগন্তুক’অন্ধত্বের প্রশ্নে জড়িত কবিতাবহির (প্র. ১৯৯১) এইসকল দার্শনিক উক্তির পরেও, তথাপি ব্যক্তিগতের প্রতি কিছু মায়া রহিয়া যায়
পথের গল্প শেষ হয়েছে, এখন অন্য কিছু বলো। অন্য গল্প।যে বাঁশির কথা বলেছিলে একদিন তা এখনও বেজে চলেছে কি? আজ তবে রেস্তরাঁর কথা বলো। শূন্যের দিকে স্থাপিত সেই রেস্তরাঁর কথা, যার সবটা শোনা হয়নি এখনও।
– অন্য গল্প / খণ্ডিত সেই সূর্যোদয়, প্র. ১৯৯৪
 

ব্যক্তি এখানে বিস্তারিত হয় কাহিনির সূত্রেউপরের ‘অন্য গল্প’ কবিতাংশটিতে যে-বাঁশির কথা আছে, তাহার সূত্র রহিয়া গিয়াছে অন্ধত্বের প্রশ্নে জড়িত-র ‘বাঁশি’ কবিতায়। আবার রেস্তরাঁর আদিকথাটি শুনিতে গেলে, ফিরিয়া যাইতে হইবে ওই বহিরই ‘সময়-প্রবাহ’ কবিতায়। বুঝা যায়, ‘বাসনা পুড়ে ছাই হয়ে যায়’ বলিয়া ঘোষণা দিলেও, পুরানো জীবনমুহূর্তগুলি তখনও কবিকে হাতছানি দিয়া চলিতেছে জীবনের প্রতিটি অনুপুঙ্খের ভিতর দিয়া যে-কবি কবিতাকে গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছেন, তাঁহার পক্ষে যেকোনও মায়ার বিস্তারই বুঝি অনন্ত সম্ভাবনাময়। তবে, পাঠকের দিক হইতে এইভাবে আত্মচরিতের ভিতর কবির তালাশ করিলে যে বিলকুল হতাশ হইতে হইবে, এই মতো ফতোয়া দিয়া গিয়াছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কবিতা হারগিজ সময়ের ভিজা ত্বকের উপর জীবনের মৃৎশকটের চাকার দাগ মাত্র নয়। তবু, কোনও না কোনও ভাবে তাহা কবির আত্মজীবনেরই এক বিস্তারও বটে। বিশেষত, কালীকৃষ্ণ গুহর মতো একজন আড়ালহীনতায় বিশ্বাসী কবির ক্ষেত্রে, জীবন আর কবিতা যেখানে ওতপ্রোত। কিন্তু সমস্যা জীবন লইয়া নয়, তাহার বর্ণনার তরিকা লইয়াসে কি সারমর্মে সংকলিত হইবে, না কি অনুপুঙ্খে উৎকলিত হইবেআরও খোলাসা করিয়া বলিলে, সে কি হইয়া উঠিবে নিবেদন, না কি প্রতিবেদন।
শেষ পর্যন্ত কালীকৃষ্ণ গুহ একজন আপামাথা নিবেদনের কবি। তবু দেখা যায়, হে নিদ্রাহীন-এর আমল হইতে, এক ধরনের প্রতিবেদন-প্রবণতাও তাঁহার কিছু কবিতায় প্রশ্রয় পাইয়াছে সেখানে তিনি, যেন বা খবর সরবরাহকারির নির্লিপ্ততায়, বহমান জীবন হইতে আমাদের উদ্দেশে কিছু তথ্য পেশ করিতেছেন হয়তো নিতান্ত আটপৌরে ১টি/২টি ঘটনাতাহার পর সেই অকিঞ্চিৎকরতাকে বেকোশেশ সম্পর্কিত করিয়া তুলিতে চাহিতেছেন এক রহস্যময়তার পরিসরে –
. রুদ্রপলাশ থেকে পূর্বপল্লী গেস্ট হাউস।/শ্রাবণ-দুপুর।/দেবদারু-পথ জুড়ে বৃষ্টি হয়ে গেছে।/‘রিকশাচালক আপনি বলে দিন কোনটা ছাতিমগাছ– /আমাদের জানা বাকি আছেকোনটা শিরীষ কুর্চি মহাশ্বেতা প্রকৃত চন্দন।’/ .../সাইকেল-রিকশার পথ বারবার বেঁকে যায় খোয়াইয়ের স্তব্ধতার দিকে। -শান্তিনিকেতন ১৯৮৫ /হে নিদ্রাহীন

. মেদিনীপুর থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার পথে আমরা দেখেছি শালবন, আমরা শুনেছি আকস্মিক চিৎকার। এই পরিচয় নিয়ে কালপুরুষের দিকে তাকাই।/ অকালবৃষ্টির এই রাত...                              প্রসঙ্গ / খণ্ডিত সেই সূর্যোদয়

দৈনন্দিনের এহেন জর্নাল হইতে সময়পরিসরহীন একটি অবস্থানকে স্পর্শের তাগিদে, এই ধরনের কবিতায়, অন্তে পঁহুছিয়া অনিবার্য এক উলম্ফনের এন্তেজাম করিতে হয়। কাজেই বর্ণনার এই ঢঙটি হামেশাই শেষ হয় কিছু নাটকীয়তা দিয়া। ফলতকিছু কবিতা আবার প্রতিবেদনের নৈর্ব্যক্তিকতা হইতে এক ধরনের গল্পের আমেজের দিকে ঢলিয়া পড়ে
অনেকদিন পর সে এল।
তখন বেলা পড়ে এসেছে
দরজা খুলে তাকে বসতে দিলাম।
সে কথা বলতে লাগল।
...

কথা বলতে বলতে সে সারাক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে
কথা শুনতে শুনতে আমিও তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

একসময় দেখলাম
স্বামীর কথা ছেলেমেয়েদের কথা গানের কথা বলতে বলতে
সে তার ডানাদুটো মেলে দিয়েছে...– ডানা/ অপার যে বিস্মরণ, প্র. ২০০৬

     কবিতার মতো করিয়া গল্প বলার এই রীতিটি নিশ্চয়ই তরুণতর কবিদের ভিতর বেশ কিছুটা গ্রহণযোগ্য হইয়া উঠিয়াছিল। কারণ, সে বেশিদিন আগের কথা না, প.বাংলার কবিতাকাগজ খুলিলেই চমকপ্রদ সব গল্প পড়িবার ফুরসত মিলিত। পাঠক হিসাবে আমরা, কবি কালীকৃষ্ণ গুহকেই, এই ধরনের গাল্পিক কবিতার প্রবর্তক বলিয়া মনে করি। এইসব কবিতা রবীন্দ্রনাথের কাহিনিকাব্য হইতে দৃশ্যতই আলাহিদা। আবার সদ্য-আবিষ্কৃত নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার মতো রূপকাহিনির যৌথ অবচেতনের পটভূমিও ইহাদের নাই। ইহারা নাগরিক ও প্রায়শই আধুনিক মনের উৎসার। এই কথা কবুল না-করিলে অন্যায় হইবে যে, এইসব প্রতিবেদনপ্রধান বা গল্পবৎ কবিতাগুলির স্বাদুতা হয়তো আমরা কমবেশি উপভোগ করিয়াছি, কিন্তু যে-শৃঙ্গলীলায় কালীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য সুপ্রতিষ্ঠিত, সেই উচ্চতা বরাবর ইহাদের কিছুটা হইলেও অপ্রস্তুত বলিয়া ঠাহর হয়
     তাঁহার শেষতম বহিগুলিতেও এই কিসিমের কবিতা ১টি/ ২টিও হাজির থাকায় বুঝা যায়, এহেন প্রতিবেদকতার প্রতি আসলেই কবির এক ধরনের নাছোড় টান রহিয়া গিয়াছে আবারএকই সাথে ঘটনার এই উদ্বর্তন তাঁহাকে পেরেশানও করিয়াছে অব্যবহিতের এই প্রপঞ্চের ঊর্ধ্বেই যে তাঁহার প্রকৃত গন্তব্য, ঢের আগেই তাহা তিনি টের পাইয়াছিলেন। তাই বুঝি বিগত শতকের শেষ প্রান্তে পঁহুছিয়া কবির কানে আরও এক আসমানি আত্মপরামর্শ ভাসিয়া আসিয়াছিল –
ঘটনাবলির মধ্যে ঢুকে গিয়ে বহুদিন ক্লান্ত হয়ে আছি
ঘটনাবলির ঊর্ধ্বে যেখানে পিপাসা জন্ম নেয়
...
সেখানে – সরল ভাষা – চলে যেতে হবে একদিন, এই জানি...  
        – ঘটনাবলির ঊর্ধ্বে / ক্লান্তির ভিতরে এই বর্ষশেষ, প্র. ১৯৯৬


৩.
আমরা দেখিয়াছি, পিতামহ, খোয়াইয়ে এসেছি-তে পাওয়া আত্মপ্রত্যাদেশ মান্য করিয়া কালীকৃষ্ণের কবিতাজীবনে প্রথম পর্বান্তরটি ঘটিয়াছিল। তাহার আধা-দশকের ভিতরেই, অন্তরের কোন্‌ এক গোপন প্ররোচনায়, এতদিনকার অভ্যস্ত কথ্যস্পন্দ ও অংশত মিশ্রবৃত্তের এলাকা ছাড়াইয়া কবি সহসা তালপ্রধান ছন্দ এস্তেমাল করিলেন। তাহা কি তবে ঘটনাবলির ক্লান্তি হইতে ‘ঘটনাবলির ঊর্ধ্বে’ উঠিবার পূর্বকথিত সলাহ্‌ মান্য করিয়া? প্রশ্নটি ধোঁয়াটে মনে হইতে পারে। কেহ বা এই মর্মে ফিরতি বিস্ময় প্রকাশ করিতে পারেন কবিতায় ভাবনাগত কোনও অবস্থান বদলের সাথে ছন্দের কী বা সম্পর্ক! এহেন অবাকপনার আড়ালে ছন্দ লইয়া এক ধরনের বিহ্বলতা কাজ করে। যাহার মূলে আছে এই সংস্কার যে, ছন্দ বুঝি বা কবিতাশরীরে নামাবলি বা আলখাল্লার মতোসে বুঝি বাহির হইতে সরবরাহ করা কোনও বেশবাসঝাড়িয়া ফেলিয়া দেওয়া বা গায়ে চড়ানো, কবির মর্জিমাফিক ব্যাপার, কবিতার তাহাতে কোনও দায় নাই। এইভাবে যাঁহারা ভাবেন, তাঁহাদের ভিতর একদল, ছন্দের জাঁক দেখিলেই তাল ঠুকিতে থাকেন এবং হাততালি দেন। যেন বা, ছন্দোবদ্ধ বাক্যমাত্রেই কবিতা! এই মানসিকতারই অপর মেরুতে রহিয়াছেন আর একদল কবিতামোদী, ছন্দের ধূপছায়াটুকু দেখিলেই যাঁহারা নাক সিটকান। যেন বা, ছন্দোহীন বাক্যমাত্রেই কবিতা! ছন্দ বা আঙ্গিক যে কবিতার আত্মার সহিত মায়ামজ্জায় জড়িত একটি ব্যাপার, সার্থক কবিতা যে নিজেই তাহার রূপটি নির্বাচন করে, এই বয়ানে হয়তো তাঁহারা ইমান রাখিতে পারেন না বাহাসটিকে মুলতুবি রাখিয়া আমরা বরং স্তম্ভিত হইয়া দেখি, মাত্র কয়দিন আগে ক্লান্তির ভিতরে এই বর্ষশেষ  বহিতে যিনি লিখিয়াছিলেন –
১. ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে উড়ে এসেছে কাক। ধোঁয়ায় ভরে উঠেছে শিশির মঞ্চ, তাঁবু। কিন্তু, প্রশ্ন : স্কুটারের শব্দ কে কীভাবে নেবে?–আবারও স্কুটারের শব্দ
২.  তুমি চুল খুলে দিয়েছ আজ প্রকাশ্য সভায়। বলেছ ‘আমিও দ্রৌপদী, হিহি, কফি বলো।’–বৃষ্টির দিনের কথা ২

অনতিদূরে পঁহুছিয়া অক্ষয়বটের দেশ পার হই (প্র. ১৯৯৭) গ্রন্থে সেই তিনিই লিখিতেছেন –
কলকোলাহল থেকে
বিষাদ জন্ম নিল
যখন শারদ মেঘে
অনায়াস কোমলতা                       
       
দেখেছি, ছাতিমতলা
মন্ত্রে রয়েছে ঢাকা
যেন এক মহাদেশ
বিষাদ জন্ম নিল  বিষাদ জন্ম নিল

প্রিয় পাঠিকা প্রিয় পাঠক, খোদ আপনারাই বিচার করুন, ইহা কি স্রেফ এক-আঙ্গিক হইতে অন্য-আঙ্গিকে বাসাবদল, না কি পুরাদস্তুর এক নয়া উপলব্ধির মহাদেশে অভিবাসন‘ঘটনাবলির’ ক্লান্তি হইতে ‘বিষাদ’-এর গভীরতায় উত্তরণ। বলিবার কথার নতুনতা হইতেই বুঝি কথা বলিবার ধরনে এই দৃশ্যমান বদল। অবশ্য রূপ, রূপবান ও রূপকারের ত্রিমুখী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও যে কীভাবে পরস্পরকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করে, তাহারও নজির কালীকৃষ্ণের এই পর্যায়ের কবিতায় রহিয়া গিয়াছে। ধরা যাক, এই কবিতাবহিরই ‘চরাচর’ ও ‘পিতাপুত্র’ কবিতা ২টির কথা। ২টি কবিতাই এক বয়স্ক পিতা ও তাঁহার কিশোর পুত্রের বিশ্বদর্শনের আবহে রচিত। একটি গদ্যস্পন্দে রচিত, অন্যটি ৬মাত্রার কলাবৃত্তে। কবিতা ২টির খানিক অংশ পড়িয়া লওয়া যাক –
১. বাবা জোরে জোরে কথা বলছে আর ছেলে উত্তর দিচ্ছে মনে মনেবাবা বলছে ‘এইসব গাছ চিনে রাখো – অশত্থ ডুমুর বট বাবলা আকন্দ নিম কামরাঙা, এইসব পাখি চিনে রাখো, এই রাস্তাঘাট, ওই অচিন পীরের দরগা, শ্মশান পেরিয়ে ওই সাঁকো।’ ছেলে মনে মনে উত্তর দিচ্ছে ‘কিছুই তো দেখতে পাইনি, শুধু এই বিকেলের আলো – অন্ধকার হওয়ার আগে  বাড়িতে পৌঁছতে হবে – শ্মশান তাহলে ওইদিকে, ওই মেঘেদের দিকে...’–চরাচর
২. থুরথুরে বুড়ো বাপ
    আকাশে তাকিয়ে দ্যাখে
    কত-না পুরাণ আর
    গতজন্মের ছাপ

    আকাশে তাকিয়ে ভাবে
    নবীনকিশোর ছেলে
    কবে ধাবমান ব্যাধ
    আকাশ পেরিয়ে যাবে

    রাত্রির আবরণ
    ঢাকে পিতাপুত্রকে
 পাতা ঝরে যায় তবু
    ঢাকা থাকে দুইজন   পিতাপুত্র

২টি কবিতাতেই পূর্বপ্রজন্মের দৃষ্টি স্মৃতিবাহিত চিহ্নগুলির দিকে, আর পরপ্রজন্ম তাকাইয়া আছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন-কল্পনায় ১মটির গদ্যস্পন্দে  উঠিয়া আসিয়াছে পিতাপুত্রের কল্পসংলাপ, ও সেই সূত্রে, দৃশ্যের মায়াময় অনুপুঙ্খতা। কিন্তু এ-কবিতার বয়ান ২চরিত্রেরদিগ্‌দর্শন ২টিকে কালের ২মাত্রায় সোপর্দ করিয়াই ফুরাইয়া যায় অন্যদিকে ২য় কবিতার চলনটি মিতায়তন। বেশি বলিবার সুযোগ সেখানে নাই। কবির সে-প্রয়াসও নাই। প্রতিবেদনের অনুপুঙ্খতার বদলে,গতজন্মের ছাপ বা ধাবমান ব্যাধ/ আকাশ পেরিয়ে যাবে’-র সাঁটে, সেখানে সামান্যেই এই কথা বলা হইয়া যাইতেছে যে, ১টি কালের সমীপতায় দাঁড়াইয়াও পিতা ও পুত্র বিপরীত ২কালের অভিমুখী। আর, অল্পে বলা হইতেছে বলিয়াই হয়তো, ১ম কবিতার মতো এ-কবিতার বয়ান এখানেই ফুরায় না। তাহা আরও সম্প্রসারিত হইবার ফুরসত  পায়। আমাদের পৌঁছাইয়া দেয় এমন একটি নজরমিনারের টঙে, যেখান হইতে অনায়াসে আমরা দেখিতে পাই, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ ত্রিকালের ঊর্ধ্বেই বহিয়া যাইতেছে এক অনন্ত সময়প্রবাহ, যাহাকে হয়তো মহাকাল বলা যায়। পিতা ও পুত্র, যে যেদিকেই তাকাইয়া থাকুক, তাহারা উভয়ই শেষ পর্যন্ত সেই মহাকালের দ্বারা আচ্ছাদিত। এই কবিতায়, বলিবার কথার ধারণা আর কথা বলিবার ধরন, কে যে কাহাকে কতদূর উস্কানি দিয়াছে, তাহা গজফিতা দিয়া মাপিবার উপায় নাই বটে, কিন্তু কথক অর্থাৎ কবি যে সেই গোপন রসায়নের পুরা ফয়দা উঠাইয়াছেন, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। পুনশ্চ, ফয়দা উঠানো কথাখানি আমরা মুগ্ধতাবশত বলিলাম
       

৪.
ছন্দে বলিলে, বলিবার কথা কেবলই বাহিরের দিক হইতে বাজিয়া উঠে, ধ্বনিসৌষম্যের অবান্তর কসরতে ফেনায়িত পল্লবিত হইয়া উঠে, বাক্‌স্পন্দ হইতে দূরে সরিয়া যায়, এইসব বিবেচনায় কবিরা একদা গদ্যচালের দিকে মুখ ফিরাইয়াছিলেন। আর, কালীকৃষ্ণ গুহ-র ক্ষেত্রে দেখিতেছি, জীবনের প্রথম ৩টি দশক মুখ্যত গদ্যে বা মিশ্রবৃত্তের মিশাল দেওয়া গদ্যে লিখিবার পর তিনি যখন ছন্দ-মিলে আসন পাতিলেন, তাঁহার কবিতা আরও মিতবাক ও অনুচ্চকিত হইয়া আসিল। তাহার ভিতর হইতে প্রতিবেদনধর্মিতা ঝরিয়া গেল। আধুনিকতার চাপে তাঁহার যে-স্বধর্ম কষ্ট পাইত, অনেক সময় আধুনিকতার হাতিয়ার লইয়াই তিনি যাহা বাঁচাইবার কোশেশ করিতেন, আজ যেন সেই প্রশান্তি ও বেদনাবোধের জটিল যুগ্মতা তাঁহার এই নতুন আঙ্গিকে ভাষা খুঁজিয়া পাইল। কবিতার কাঙ্ক্ষিত অব্যক্তকে তিনি যেন বহুদূর অবধি স্পর্শ করিতে পারিলেন। কিন্তু তাঁহার বৈচিত্র্যপিপাসা কোনও আঙ্গিককেই অচ্ছুত করিল না। ছন্দ ও অ-ছন্দে তিনি পাশাপাশি ও সচ্ছন্দে লিখিতে লাগিলেন।
     এই অনুষঙ্গে কয়েকটি কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধার করিবার খায়েশ দমাইতে পারিলাম না। জীবনের, সম্পর্কের, সকল রহস্যের, টানাপড়েনের, শুরু ঠিক কবে হইতে – ইহাই হইতেছে প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উপর দিয়া একবার একদিন এইভাবে জন্মান্তরের বাতাস বহিয়া যায় –
একদিন বলেছিলে
‘শুরু করা যাক তবে –’
বহু বৃষ্টিতে ভিজে
প্রশ্ন করেছি ‘কবে?

কোনখান থেকে শুরু?’
উত্তর নেই কোনো
গতজন্মের হাওয়া
বলে গেছে ‘শোনো শোনো –’
  গতজন্মের হাওয়া / স্মৃতিহীনতার মধ্যে নিস্তব্ধ পুরাণ, প্র. ১৯৯৯

আমাদের হৃদয়ানুভূতিগুলির বাস্তবিক যেন কোনও শুরুশেষ নাই। শেষ বিচারে তাহা যেন এক মহাজগতিক রহস্যের সাথে সুদূরপ্রসারী তারে তারে বাঁধা। তবু, এহেন নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তির মর্মমূলে পড়িয়া থাকে কিছু রক্তমাংসের ঘটনাবৃত্ত। দার্শনিকতাও যেমন সত্য, জীবনও কিছু মিথ্যা না। সেই বৃত্তান্তও পিছু ছাড়ে না। এক বহি টপকাইয়া অপর বহিতে গিয়াও সে নিজের বয়ান কবুল করাইয়া লয়তবে সেই বয়ানের অন্বয় ও প্রস্বর স্বতই আলাহিদাকারণ স্মৃতি ছানবিল করিয়া তাহাকে পেশ করিতে হইতেছে ঘটনার আনুপূর্বিকতা–
আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কত-না চিৎকার আর ধুলোর আস্তরণ। একদিন তুমি বললে‘যা ঘটে গেছে, ধীরে ধীরে তার সবটুকু বুঝে নিতে হবে।’ বললাম‘তুমি চলে গিয়েছিলে, অনেক দেরিতে হলেও ফিরে এসেছ আবার। এইখান থেকে বোঝাপড়া শুরু।’কিছুক্ষণচুপ করে থেকে বললে ‘আরও কিছুটা আগে থেকে বুঝতে চাই। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখলাম সেদিন থেকে।’বললাম ‘তাহলে সেই স্কুটারের কথাও এসে পড়বে; বরং সেই ছাতিমগাছ রৌদ্র এবং দিনাবসানের কথা থেকে শুরু করা যায়।’–  সম্পর্ক ৭ /গতজন্মের গ্রীষ্মকাল, প্র. ২০০১

শুরুর কথা লইয়া এই আলাপচারিতা একসময় শেষ হয়। একদিন শেষ হয় সেই আলাপের স্মৃতিচারণাও। সময় বহিয়া যায় আরও। তাহার পর হয়তো আবার একদিন বুঝা যায়, শুরুর কথাগুলি কিছুই ঠিকমতো বলা হয় নাই। আবার এক অনিশ্চয়তার পাঠে গিয়া পৌঁছাইতে হয় তখন

আরম্ভের কথাগুলি
হয়নি বলা বুঝি আজো
শেষের কথাগুলি থাক
না-বলা সময়ের মাঝে।

সকল পাঠে ভয় জমে
সকল বিশ্রাম ফাঁকা
ও কোন গ্রহ জ্বলে, ভাবি
স্মৃতি যে কোন ছবি আঁকে!–  আরম্ভের কথা /অপার যে বিস্মরণ  প্র. ২০০৬

এইভাবে, গ্রন্থ হইতে গ্রন্থান্তরে, কবির এমন কিছু অনুভাব পরিকীর্ণ হইতে থাকে, যাহা হয়তো বা সমমেল অভিজ্ঞতার প্রস্থানভূমি হইতে উৎসারিতকিন্তু উপলব্ধির ক্রমিক বিস্তারে তাহাদের পাঠ কেবলই বদলাইয়া যায়। আঙ্গিকও। কবির এই চলনচিহ্নগুলি বা জ্বলনচিহ্নগুলি, পাঠক হিসাবে আমাদের বিস্মিত প্রাপ্তি হইয়া থাকে। যেমন, বিগত শতকে রচিত তাঁহার আখেরি কবিতাবহিটির একটি দীর্ঘকবিতার এই অংশে শুনি স্থিরতার প্রত্যয়ে পঁহুছিবার এমন সব সংকল্প –
সমস্তরকম অস্থিরতা থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম আমরা
আমি বলেছিলাম এই-যে আকাশ, যা অস্তিত্বহীন শূন্যতা মাত্র
এরই মধ্যে মাথা ডুবিয়ে বাঁচতে হবে, স্থির হতে হবে’
তুমি বলেছিলে ‘যে বিরহের মধ্যে রয়েছি সেখানেই থাকতে চাই,
                        সেখানেই স্থির হতে চাই –’
          কাক ডাকছে / গতজন্মের গ্রীষ্মকাল

বুঝিতে অসুবিধা হয় না,উদ্ধৃত অংশে শোভিত প্রশান্তির আড়ালে আসলেই বিগতগ্রীষ্মের দহন হইতে বাহির হইয়া আসিবার একটি টানাপোড়েন ছটফট করিতেছে। বাস্তবে, প্রকৃত স্থিরতায় পঁহুছিবার পথ কেবলই দীর্ঘ হইতে থাকে। দীর্ঘ হইতে থাকে কথোপকথনের বিস্তার। প্রলম্বিত হইতে থাকে বিদায়গ্রহণের মুহূর্ত। পরবর্তী বহিতে পঁহুছিয়া, আরও এক দীর্ঘকবিতায় কবিকে তাই কবুল করিতে দেখি –
বললাম‘যা-কিছু হারিয়ে গেছে তার জন্য হঠাৎ
চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে
অথচ যা-কিছু হারিয়ে গেছে তার মধ্যে শান্তি খুঁজে পাই।
তার সবকিছুর জন্যই নীরবতা পালন করি।’

এই কথোপকথনের পর পরস্পরের কাছ থেকে
                বিদায় নিয়েছি আমরা। তখন
মাথার ওপর অবিশ্বাস্য সেই জারুলগাছ।–  আনন্দযাত্রা /অপার যে বিস্মরণ

     কিন্তু বারবার ঘোষণা দিলেও, চট করিয়া বিদায় লওয়া যায় না। বা লইলেও, পিছুটান রহিয়া যায়। জীবনের ‘এই গোধূলি-ঘেরা বেলা’য় মাঝে মাঝে সেই টান কিছুটা ভয়ও দেখায় বই কি! সেই ‘অগ্রন্থিত ভয়’-এর কথাটি ধরা পড়ে এই বহিরই অপর এক কবিতায়, আবার এক ভিন্ন উপস্থাপনায়
তোমায় বলি, ‘সামনে দূরে কেন
আমায় নিচ্ছ টেনে?
এখন এই গোধূলি-ঘেরা বেলা
নশ্বরতায় মেনে

নিয়েছি এক নিথর কৌতুকে –
আর তো কিছু নয়’
বলেই ভাবি সামনে আছে কিছু  
অগ্রন্থিত ভয়।

ভয়ের দিকে আরও অনেক পথ
তোমার থেকে দূরে
পেরিয়ে যাব। রাত্রি। বহুতারা
গগনতল জুড়ে।              - কৌতুক /

এইবার তবে অজানা সুদূরের দিকেনতুন এক পদযাত্রা গড়িয়া উঠিবার সময় হইল।নৈর্ব্যক্তিক প্রৌঢ় সৌন্দর্যেরএকাগ্রতায় তাহারই নির্মোহ গদ্য-ইস্তাহারটি যেন শুনা গেল এইভাবে –
সবকিছু বুঝে নিতে হবে।/ এখন নারীকে বুঝতে হবে কিছুটা দূর থেকে।/ সময় ও শিল্পকেও কিছুটা দূর থেকে বুঝতে হবে।/ সবকিছুই দূরে সরে গেছে কিছুটা।/ প্রতিবেশীরা দূরে সরে গেছে/ পিতৃলোক দূরে সরে গেছে।     বিরতি /

আর সেই পালটাইয়া যাওয়া পরিপ্রেক্ষিতের উদাসীন আত্মমগ্নতাটুকু যেন অস্ফুট স্বগতোক্তির মত ঝরিয়া পড়িল এই অনুচ্চকিত ছন্দে –
আকাশে তাকানো/ রাত্রির/ এই শুধু তার/ বাকি কাজ/ #/ দিনগুলি যায়/ ঊর্ধ্বে/ পাখি ওড়াউড়ি/ মন্তাজ/.../ভোর থেকে ডাকে/পাখি সব/ফেরিঅলা বলে,/‘দিন যায় –’/ #/ সন্ধ্যায় কত/ ঝিঁঝিঁ ডাক/ মাঝে মাঝে তারও/ ঘুম পায়।      - রাত্রিগাথা /


.
এতদূর আসিবার পর ২টি বাক্য স্মরণে আসায় খানিক নাচার বোধ করি। ২টিই কবি কালীকৃষ্ণ গুহ-র উক্তি। নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতা-র ভূমিকায় করা একটি মন্তব্য মোতাবেক, কালীকৃষ্ণর কাছে কবিতা ব্যাপারটি ‘অব্যক্ত থেকেঅব্যক্তে পৌঁছোনো...শেষপর্যন্ত’অব্যক্ত থেকেঅব্যক্তেশিরোনামে কবির একটি স্মরণীয় নিবন্ধও আছে। যেখানে তিনি আরও একটি ধুয়া উচ্চারণ করেন–‘আমরাভাষা পড়ি না, মন পড়ি’এই বাক্য ২টির অমোঘতা যেমন আমাদের অভিভূত করে, তেমনই এই উচাটনেও পড়ি, যে, আমরা তো কবির কবিতায় কী ব্যক্ত হইয়াছে, তাহারই পিছু ধাইতেছি। আমরা বুঝি কবির মন না পড়িয়া ভাষাই পড়িতেছি।
     প্রিয় পাঠিকা প্রিয় পাঠক, আমাদের অসহায়তা আমরা কবুল করি। কিন্তু বেহুদা বিনয় করিয়া ফয়দা নাই। কারণ কবিই অন্যত্র আমাদের ভরসা জুগাইয়াছেন – ভাব থেকে ভাষা/ ভাষা জেগে থাকে দেহে। তাই আপাতত ভাষাতুতো সেতুবন্ধের ভিতর দিয়াই কাঠবিড়ালির মতো আমাদের আরও কিছুদূর আগাইতে হইবেটের পাইতে হইবে ভূসমলয়কক্ষপথে স্থিত এক আকাশযানের ভাবগতিক। দুনিয়া হইতে উৎক্ষিপ্ত হইয়াও যে মাটিপৃথিবীর সাথে নিবিড় টানে বাঁধা। ওই আমাদের স্থিতপ্রজ্ঞ কবি, শুরু হইয়াছে তাঁহার নিরাসক্ত অথচ মগ্ন, নয়া সফরনামা।
পথিকতার মানে আসলে এক ধরনের উদাসীনতা। পটভূমির সকল মায়াময়তার ভিতর দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে নিজেকে অংশত প্রত্যাহার করিয়া লওয়া। পথিকতা মানে এক নির্লিপ্ত নিরন্তর উদ্যম। সূর্যোদয় হইতে সূর্যাস্ত, সমস্ত পরিসরটুকুই পথিকের কাম্য। কিন্তু সে জানিয়াছে –সমস্ত রকম প্রস্তুতির উৎসে অন্ধকার (নিষ্পলক / পথনাটকের আসরে স্তব্ধতা, প্র. ২০০৮)সে জানিয়াছে – অন্ধকার রাত।/ অন্ধ সহযাত্রীদের সঙ্গে এগিয়ে চলেছি/ অন্ধত্বের সাধক একজন (সমান্তরাল/) সে জানিয়াছে –... তুমি দীর্ঘ একটা/ ভ্রমণে বেরিয়েছ।/ অস্পষ্ট সব রাস্তাঘাট ধরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের/ ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছ তুমি/#/ আর ফিরবে না...  (বধিরতা/ একাকিত্ব/ )
‘অস্পষ্ট সব রাস্তাঘাট’এর ‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভিতর’ লিপ্ত না হইয়াও পথিকের মনে প্রশ্ন জন্ম হয় তবু নিরুত্তর স্তব্ধতার উদ্দেশে এই প্রশ্ন উচ্চারণের অনুষঙ্গ কিছুদিন হইতেই কবির ব্যাকুল স্বগতোক্তির ভিতর দিয়া  উঠিয়া আসিতেছিল –
১. প্রশ্ন করে নারী/ সময় প্রশ্ন করে / প্রশ্ন করে পথিক/ সকল স্তব্ধতায় -/ নিশানগুলি ওড়ে/ পাতারা ঝরে যায়
  যেদিকে চাও পাথর/গতজন্মের গ্রীষ্মকাল

২. নীরবতা ভেঙে জ্যোৎস্না ভেঙে পুরাণবাস্তব ভেঙে/ প্রশ্ন করেছি/ প্রশ্নের ভিতরে ভিক্ষা/ প্রশ্নের ভিতরে কত ঝরাপাতা আমের মুকুল
- রাস্তাঘাট / অপার যে বিস্মরণ

এইভাবে, উত্তরের পরোয়া না করিয়া, এমন কি, হয়তো উত্তর আদৌ নাই, এই কথা জানিয়া, প্রশ্ন তোলার স্বাধীনতা বহাল রাখাও পথিকতার এক ধর্ম। ইহাও এক ধরনের নির্লিপ্তি। আকাঙ্ক্ষাহীন, তবু নিরলস প্রশ্ন উচ্চারণের নির্মোহতার ভিতর দিয়াই হালফিল এই ভ্রামণিকতায় কবি গড়িয়া তুলিয়াছেন অবিস্মরণীয় সব কবিতার মুহূর্ত–
১. প্রশ্ন করেছি, খুঁজিনি তো/উত্তর/ সকল কাব্য অতিথিশালার/ রাত্রি।–না-জানা /পথনাটকের আসরে স্তব্ধতা

২. এই না-জানার সৌন্দর্য ঘিরে আমাদের বসবাস –/ অশ্রু, সাধনা, মৃত্যুবোধ।/ আনন্দও অনেক।–  পাপপুণ্য /

৩. অনেক দিনের প্রশ্ন নিয়ে/ গড়ে উঠছে জীবনবীক্ষা/ এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে/ তার কাছে যাই ছন্দভিক্ষু।–ছন্দভিক্ষু /

৪. শুরু নেই শুরু ধারাবাহিক/ শেষও নেই, শেষে অজানা বাঁক-ধারাবাহিক /

৫.   - কথা শেষ হল?
- কথা শেষ কখনো হবে না
- শেষকথা কিছু নেই?
- ধন্যবাদ ক্রমঅগ্রসরমাণ নিরবয়ব মৃত্যু –  নতুন বছর ২০১১, বৃষ্টির দিনে ভ্রমণ, প্র. ২০১২

৬. যদি শেষ হয় বাক্য/ প্রশ্ন করেন শিক্ষক/ বাক্যের শেষে অর্থ/ যারা খোঁজে তারা প্রার্থী –অক্ষর /পানসুপারির বন্ধন, প্র. ২০১৩

৭. প্রশ্ন কী আজ?/ প্রশ্ন দূরের থেকেও সুদূর/ দিগন্তপার উন্মোচনে/ জীবনধারা কীভাবে পায়/ মন্দ্রস্বরের পথিকভাষা/ একটি কুপি/ জ্বালিয়ে রাখে পথের কবি। –  পথিকভাষা /

আমাদের মনে পড়িতে পারে, পুরানো একটি পথ শেষ হইয়াছিল  এক ‘অগ্রন্থিত ভয়’ দিয়া তুমি-র সাথে আমি-র এক জটিল বোঝাপড়ার রহস্যে। আজিকার পথটি যেন গড়িয়া উঠিয়াছে সেই তুমি-কে যথাযথভাবে মোকাবিলাকরিবার সাফল্যে।  তাই আজিকার এই পথিকতাকে মনে হয় যেন কোনও গ্রহান্তরের আলোয় অভিষিক্ততাহার একটি পাঠে  ‘বাসনাহীনের ভাঙা হাটে একা একা ঘুরি’য়া বেড়ানোর নির্মোহতা অপর পাঠে, ‘ব্রতপালনের শেষে আমরা সবাই পথিক’, এমন এক সানন্দ উপলব্ধি। তুমি-র পুনর্নির্মাণ না-করিতে পারিলে, আমি-র এই নির্ভার পরিক্রমণ কি আদৌ সম্ভব হইত?
     যে-নিরুত্তরতাকে পাথেয় করিয়া এই অভিযাত্রা, দেখি, তেমন এক না-জবাব প্রশ্নের বিপরীতেই এইবার আসিয়া দাঁড়াইয়াছে সেই তুমি। সে এক অ-জ্ঞাত তুমি। যেন তাহার সেই অস্পষ্ট অথচ নিশ্চিত অস্তিত্বকে লইয়াই গড়িয়া উঠিয়াছে আমি-র সকল প্রশ্নের নিরলসতার উৎসার–
‘দাঁড়িয়ে রয়েছ ও কে, তুমি?
এই প্রশ্ন যাকে করি তার
মুখ দেখা যায়নি কখনো
প্রশ্নের ভিতরে মরুভূমি। – প্রতীক্ষা / পথনাটকের আসরে স্তব্ধতা

যদি সেই মুখ দেখা যায়ও,ধরা পড়ে,চিরদিনই তাহা ছিল অস্পষ্ট, আংশিক।আজ সেই অস্পষ্টতা শনাক্ত হইল
বহুদিন পর দেখলাম তোমাকে। তোমার নাম মনে রাখিনি, রূপ মনে রেখেছি...কেউ তোমার মুখের পুরোটা দেখতে পেত না।...
এতদিন পরেও দেখলাম তোমার মুখ অংশত ঢাকা।–দেশকালের কথা / বৃষ্টির দিনে ভ্রমণ

     তথাপি, অজানা বা অংশত জানা হইলেও, আজও সেই তুমি-কে ঘিরিয়া সম্পর্কের কত অভাবিত অঙ্কপাত অনুভূত হয়, আজও জাগিয়া উঠে আরও কত সংকেতবাহী প্রশ্ন–
. তোমার আমার বাধ্যতা তো/ হঠাৎ-নামা বজ্রপাতে! -  সম্পর্ক / পানসুপারির বন্ধন

. তোমায় নিয়ে যাত্রা ছিল/ বৃষ্টিভেজা পথে/ আমার মধ্যে অনন্ত রাত/ পথটি গেল কোথায়?–  বিস্তৃতি /

. কোথায় ছিলে তুমি/ নিদ্রাহীনের রাতে?/ প্রশ্ন করে বুঝি/ সব আলো সাংকেতিক।      সাংকেতিক /

     অজানা উত্তরের এইসব প্রশ্নগুলি, অনুভবগুলি, লালন করিয়া যেমন আজিকার এই চলাচল, তেমনই সেই অজানা তুমির সহিত অধিবাসে এই চলার আনন্দের উদ্ভাস –
তোমাকে কেউ জানে না
তুমি অনন্ত অপার
না-জানার আনন্দরূপ
তোমাতে রোরুদ্যমান।– ঝিঁঝিঁডাক /পানসুপারির বন্ধন

     কিন্তু এত কথা ঘনাইয়া উঠে কাহার উদ্দেশে, তাহা কি বিন্দুবিসর্গও টের পাওয়া যাইবে না? তবে কি এই সকল আলাপই এক কিসিম প্রলাপ মাত্র! না কি শ্রোতা একজন কেহ আছে। কথকের নিজেরই ভিতরে বুঝি টইটম্বুর হইয়া আছে সেই আয়োজন –
তবু     কথা বলেছ অনেক
কথা    নিজের সঙ্গে শুধু
যেন    একাই দুইজনা
যেন    পাত্র ভরছে সুধায়!        – বুড়ি-ছোঁয়ার খেলা /

এইভাবেই বুঝি সেই পুরানো তুমি-র পুনর্নির্মাণ আসিয়া একটি বিন্দুতে স্থিত হয়। ব্যক্তি মুছিয়া গিয়া ধারণার জন্ম হয় অবশেষে। একটি কবিতা পাঠ করি এই প্রস্তাবের সমর্থনে –
তোমাকে দিইনি কিছু –
তবুও আগুন জ্বেলে
রেখেছিলে তুমি নিজে;
আজ এই কথা বলি।

কাকে বলি এই কথা?
স্মৃতিহীনতার দিকে
তাকিয়ে থেকেছি শুধু –
যেন শূন্যতা আঁকা!

শ্রোতা পাইনি তো খুঁজে
নিজেকেই বলেছি তা
আলো জ্বেলেছিলে তুমি
নিদ্রাহীনের শীতে।

ঝাউ-দেবদারু ঘেরা
গহন তোমার বাসা
তোমাকে গ্রহণ করি
পুরোনো কাব্যভাষায়। – নিদ্রাহীনের শীত /


৬.
টেবিলের উপর তুরুপের তাসের মতো একটি কবিতাকে ঠকাস করিয়া ফেলিয়া একজন কবির মর্মলোকের হদিশ দিবার চেষ্টার ভিতর কিছু নাট্য রহিয়া যায়। অনাগত পাঠকের মতলবের দিকে তাকাইয়া তো কবিতা রচিত হয় না। কবিতা রচনার পিছনে কবির এক ধরনের অসহায়তাই কাজ করে। চালাকির কবিতা, মাঞ্জামারা কবিতা বা দুনিয়া উল্টাইয়া দিবার প্রণোদনায় লিখা কবিতাসকলের কথা হইতেছে না। অন্যথায়, বিশুদ্ধ কবির অসহায়তা দ্বিবিধ। পহেলা, রচনার কর্তাগিরি লইয়া রচিত ও রচয়িতার দ্বান্দ্বিকতা তিনি মানিয়া লন। ধূসর কুয়াসার ভিতর ভাসিয়া উঠা একটি সেতুর ছবির উদ্ভাস হইতে ক্রমে তিনি ২টি বিচ্ছিন্ন পরিসরকে জুড়িয়া দেন বটে, কিন্তু নিছক প্রকৌশলীর কায়দায় নয়। মাঝের শূন্যতাটুকুও তাঁহাকে এন্তার সম্মোহিত ও প্রভাবিত করে। ফলে, সকল কর্মসূচি তত্ত্ব নীতিকথা মতাদর্শ সমগ্র নির্মাণটির ভিতর বিলীন হইয়া যায়কবির দোসরা মুশকিল এই যে, এইসব কথা বুঝাইবার জন্য তিনি পাঠকের সামনে সশরীর হাজিরায় থাকেন না।
     এমনতর অবস্থায় পাঠকের এলেমদারি নিরঙ্কুশ হইয়া উঠে বটে। যা-ইচ্ছা-তাই গ্রহণ-বর্জন করিবার স্বাধীনতা তাঁহাতে বর্তায়। তাই বলিয়া কাটা-ছেঁড়ার যাচ্ছেতাই রকম বাড়াবাড়িও কবিতার ধর্মে সহে না। অতএব আমাদের এইবার ক্ষান্ত দেওয়াই উচিৎ। থামিবার আগে, আমরা কবির আর একটি কবিতা পড়িয়া লইতে পারি –
এবছর বৃষ্টির দিনগুলিতে তোমাকে
কাছে পাইনি।
না-পাবারই কথা –
না-পাওয়াতেই আজ আমাদের যা-কিছু বাঁচার গৌরব।

নিঃসঙ্গতার ভিতর দিয়ে গিয়ে
আমরা যে-গৌরব অর্জন করলাম
তা অবশ্য প্রকাশ করার নয়।
সেই গৌরবের চারপাশে গাছপালা
সেই গৌরবের নিঃসঙ্গতার পশ্চিমে সূর্যাস্ত।

সেই গৌরবই প্রকাশ পাচ্ছে
আজ শ্রাবণশেষের এই অবিরল বৃষ্টিধারায় ...–  গৌরব / নিঃসঙ্গতার পশ্চিমে সূর্যাস্ত , প্র. ২৫ বৈশাখ ১৪২০

     অঝোর বৃষ্টির ভিতর দিয়া প্রকাশমান শ্রাবণের এই গৌরব, ব্যক্তিকে পিছনে ফেলিয়া জাগিয়া উঠাএক ধারণার গৌরব। একটি কবিতাজীবনের দীর্ঘ পদপথযাত্রার গৌরব। সেই গৌরব সমস্ত প্রকৃতির উপর বিস্তারিত হইয়া আজ এই পৌষরাত্রির হিমানির ভিতর দিয়া আমাদেরও কিছু স্পর্শ করে  সেই সূত্রে, কবি কালীকৃষ্ণ গুহ-কে আমাদের প্রণাম ও কৃতজ্ঞতা জানাই¤

পৌষ ১৪২০


[লেখকেরএকবচন, বহুবচন (প্রকাশক :বইতরণী)গ্রন্থটি থেকে পুনর্প্রকাশিত]
 







বাক্যহীন 

অন্ধকার দিন ছিল আজ। 
পিছনে আরও অনেক অন্ধকার দিন 
রয়ে গেছে। 

অন্ধকার দিনে কথা বলার শান্তির মধ্যে 
বসে ভাবি, 
কথা না-বলাই ভালো। 
সমস্ত কথা ছোটো হয়ে আসে শেষপর্যন্ত— 
তুচ্ছ হয়ে আসে। 

লক্ষ করি, 
কথার সমগ্রতায় নির্বাক ব্যক্তিমানুষ — 
কথার তুচ্ছতায় দূরে একটা-দুটো 
নিশান উড়ছে। 

দেখি, 
বাক্যহীনের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় 

বাক্যহীনের পাশে বিধ্বস্ত পুরোনো সেই 
মহাকালের মন্দির। 


প্রথম সাক্ষাৎ

তুমি বলেছ, ‘ভুলিনি’।
ভুলবে না জেনেও মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম-
তা ছিল অপ্রয়োজনীয়।

না-ভোলাই স্বাভাবিক, জানি।
জানি, এই কথা থেকে বেরিয়ে গেলেই
দক্ষিণের হাওয়া এসে গায়ে লাগবে-
যেন একটা যুগ পার হওয়ার মুখে এসে পড়েছি!

সংসার তোমাকে দুঃখ দিয়েছে-
আনন্দ দিয়েছে আরও বেশি।
আনন্দের কথাগুলি মনে রাখবে না?
মনে রাখবে না যে
বিস্মিত হয়ে থেকেছ কতদিন কত তুচ্ছ কারণে?

স্মরণ-বিস্মরণের এই জীবন আমাদের-
আমরা পরস্পরের মুখোমুখি হচ্ছি বারবার।
তবু প্রত্যেক বারই মনে হয়
এই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ…


অলৌকিকের দিকে

সেদিন তুমি বলেছিলে,
‘আমাকে নিয়ে একটা প্রেমের কবিতা লিখুন -’
সেইদিন থেকে তোমার দিকে আর
তাকাতে পারিনি।

সেইদিন থেকে মনে হয়েছে
অচেনা একটা দিগন্তবিস্তৃত মেয়ে। অলৌকিক।
অলৌকিকের দিকে তাকানো যায় না।

মনে পড়বে,
‘অলৌকিকের কাছে সকল আকৃতি ঝরে যায়।’
বলেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।






সড়ক পথে সকট চলে দ্রুত
শুভাশিস ভাদুড়ী

“আমার শরীরের ওপর দীর্ঘ ছায়া
ডাক-
যেতে যেতে আমি সেই ডাক শুনতে পাই”
(“ডাইরির পাতা থেকে” কাব্যগ্রন্থের দুই সংখ্যক কবিতা টুকরো)
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ রক্তাত্ব বেদীর পাশে” বইটিতে এই কবিতাটি আছে। বলা যায় এই তিনটি লাইন কবি কালীকৃষ্ণ গুহ-র কাব্যভাবনার ধাতুসূচক।

১৯৬৭-২০১৯ কালীকৃষ্ণ গুহ-র প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে অধুনা প্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থের এই অর্ধ শতক, অতিক্রম করতে করতে উক্ত ছায়া দীর্ঘতর হয়েছে, চলন হয়েছে চংক্রমন। ৫২ বছরের ক্রমপরিবর্তিত দৃষ্টিশৈলী ও প্রকাশভঙ্গী , ব্যক্ত থেকে অব্যক্তে পৌঁছে যাওয়ার যুগপত আকুতি ও পরিশ্রম নিয়ে মর্মলোকের রৌদ্রছায়ার উদ্ভাস হয়ে ধরা পড়েছে প্রতিবেদনে। বেদনা বোধ ও নীরবতার ওই প্রতিবেদনগুলিই শ্রী কালীকৃষ্ণ গুহ-র কবিতা বা এক কথায় জীবন চৈতন্য।

লিখতে বসে সময়ের অনুধাবন কবি মাত্রই করতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রেও কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু অনেক সময়ই অনুধাবন হয়ে ওঠে সময় চিহ্নের অবাধ দাসত্ব। কালীকৃষ্ণ গুহ তথাকথিত “ আধুনিক সংবেদ”-কে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে কখনও “আধুনিক” কবিতা লেখার চেষ্টা করেন না, বরং সুকৌশলে ভাষার মৌখিক চলনকে এমনভাবে ব্যবহার করলেন যে আটপৌরে কথকতা হয়ে উঠল তার স্বভাব আর কথার আঁশের ভেতর যে কাব্যপ্রাণ প্রতিষ্ঠিত হল তার মেজাজ মহাকাব্যিক ঐতিহ্যের বিভায় উজ্জ্বল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ থাকা ভালো যে, যাপন চিহ্নে গীতিকবিতা অথচ ধর্মে ক্লাসিক, এই বস্তুবাদী দ্বন্দমূলক অবস্থান কবিতাগুলির মধ্যে এক সাংকেতিক বার্তাজ্ঞান রোপণ করে যা পাঠকদের জন্য সম্পদ হয়ে লুকিয়ে থাকে কাব্যগ্রন্থগুলিতে। তাই কি কাব্যগুলিতে যতিচিহ্নের ব্যবহার কম! অর্থাৎ হে পাঠক নিজ পাঠ্যক্রম অনুযায়ী বিন্যাসের আস্থায়ী ও অন্তরার সুরারোপ নিজে করে নিন। ভার বহন করুন কাব্যপঙক্তির চলন পরিমিতির। শ্রমবিমুখ পাঠক কালীকৃষ্ণ গুহ-র কাছে ত্যাজ্য।

আবার এভাবেও দেখা যেতে পারে যে ওই সংকেত অভিজ্ঞান চিহ্নময় কাব্য ধর্ম আসলে নৈব্যক্তিকতারই ফসল। কবি যখন কথক তখন যথেষ্ট পরিমাণে মরমী তাতে সন্দেহ থাকে না। জীবন যাপনের সমস্ত সংবেদকে পরম মমতায় স্পর্শ করতে চাইছেন, কখনও পারছেন আবার কখনও যাপন উন্মোচন করছে ক্ষতমুখ। তবু অশান্তি নেই, কেননা প্রায় সামবেদীয় এক নৈব্যক্তিকতা কালীকৃষ্ণ গুহ রপ্ত করেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে। উৎসুক পাঠককে “পান সুপারির বন্ধন” বইতি খুঁটিয়ে পড়তে অনুরোধ করব।

এই ভঙ্গি আকাশ থেকে দৈব আয়ুধের মতো আহোরিত হয়নি বরং উঠে এসেছে জীবনযাত্রার অনুভবকে এক “রাজনৈতিক” দৃষ্টি থেকে বিশ্লেষণ করে। সেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আমরা একটু বাদে সংক্ষেপে বুঝে নেওয়ার চেষ্টাও করব। কিন্তু এ কথা বলাই যায়, যে ঐতিহ্য, চর্যাপদ থেকে বৈষ্ণবপদাবলী কর্তাদের ঋদ্ধ করে রবীন্দ্র ভাবনার উত্তুঙ্গ রূপ পেয়েছিল, কালীকৃষ্ণ তাকেই যথাযথ মর্যাদায় আপন করে নিয়েছেন, অনুকরণ নয়, অনুরণিত হয়েছে ঐতিহ্যের অভ্যেস, বিশেষত, “হে নিদ্রাহীন” কাব্যগ্রন্থ ও তৎপরিবর্তিত কবিতাবলিতে।

আসলে কালীকৃষ্ণ গুহ-র পুর্ববর্তি সময় জুড়ে এক অস্থির স্বদেশহীনতার আতঙ্ক ও উচ্ছেদের আখ্যান রক্ত, পুঁজ, ক্লেদ ক্লান্তির শিল্পিত বিবরণে স্থানাঙ্কহীন বাংলার পরিচয় বহন করতে নিজে বাধ্য হয়েছিল পাশাপাশি বাধ্য করেছিল চেতনাকেও। ৬০ দশকে বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি কবি ও বিশেষত কালীকৃষ্ণ গুহ নির্মাণ করলেন আখ্যানের এমন এক দেশজ ভূমি যা ব্যাষ্ঠির হয়েও ব্যক্তিবিষেষের নিজস্ব পদচারণার জায়গা হয়ে উঠবে ক্রমে, যা তাঁর পূর্ববর্তিদেরও অনতি বিলম্বে বিভাবিত করবে এবং তৈরী করবে বঙ্গবোধ নামক এক স্থানিক জাতীয়তা-লক্ষ্যণকে। (কবি গৌতম চৌধুরির বঙ্গবোধের বীজটি এখানেই লুকিয়ে? পদচিহ্নের ধারাবাহিকতায় উৎসাহব্যঞ্জক এই প্রশ্নটি এখানে তুলে রাখা গেল)। ১৯৭২ পরবর্তী কাব্যসংকলনগুলিতে এই রাজ্য রাজনীতির আবহাওয়া থাকলেও প্রকৃতিদত্ত এক সনাতন রাজনৈতিক দর্শনই বহুমাত্রিকতায় বেজে ওঠে কালীকৃষ্ণ-র কলমে।

প্রকৃতিগত ক্ষমতার বিন্যাস ও তার ভারসাম্যের সুচারু কাঠামো হয়ত কিছুটা সজ্ঞানেই পাঠ করলেন কালীকৃষ্ণ গুহ। নিরীশ্বরবাদী ব্যক্তি কালীকৃষ্ণ ক্ষমতার টানাপোড়েন সহ্য করেও ক্ষমতার আগ্রাসনবাদী রূপকল্পের বিপ্রতীপে যে কল্যানশ্রীময় অথচ দৃঢ়  প্রাকৃতিকতা, তাকেই সদর্থে আদর্শ বলে মেনে নিলেন অন্তত কাব্যপ্রকল্পের ক্ষেত্রে তো বটেই। তাই হয়ত কয়েক দশক পেরিয়ে তিনি নিজেই বলবেন – “ জীবন থেকে যা কিছু হারিয়ে গেছে তার জন্য দুঃখ হত একসময়। এখন আনন্দ হয়। মনে হয় ভারমুক্ত হওয়া গেল কিছুটা। সমস্ত ঘটনাবলির পিছুটান,  বিরহবোধের ধারা,  শীত বসন্তের সুসময়, গ্রীষ্ম দিনের উদযাপিত দাহ, পার হয়ে আসা কত মৃত্যুযোগ- সব বহন করে যাওয়া সম্ভব নয়। এইসব কিছু কিছু হারিয়ে ফেলতে ফেলতে বহনযোগ্য করে নিতে হয় এগিয়ে যাওয়ার স্বার্থে – মৃত্যু পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া। এখানে “ভারমুক্ত” ও “হারিয়ে ফেলা” শব্দ দুটি বিশেষ প্রণিধান যোগ্য। ভারমোচন, নতুনের আবাহন ও পুরনোকে বিয়োগ করে ফেলা,  এ যেন প্রাকৃতিক ক্ষমতার কাঠামো বিন্যাসের এক সরল অথচ রৈখিক পরিচয়। ক্রম বিবর্তন ও বিনাশকেই বিশেষ অর্থে নিয়ামক হিসেবে মান্য বলে মেনে নেওয়া। “অপার হে বিষ্মরণ” বইয়ে “স্রোত” কবিতাটি উৎসুকদের একবার পড়ে দেখতে বলব।

হয়ত এভাবেই কালীকৃষ্ণ গুহ-র কবিতার আঙ্গিকগত ও বিষয়গত বিবর্তনের ধারাটিও প্রায় প্রাকৃতিক বিবর্তনের সমরূপ। ৫২ বছরের ফসল একটানা পাঠে বিষ্ময় জাগাতে পারে যে, যেন এক দীর্ঘ কবিতারই পাঠ শেষ হল। তবে কি কবি একটাই দীর্ঘ কবিতা গোটা জীবন ধরে লিখে চলেছেন এখনও! আত্মগত স্বরে খুঁটিনাটিউপাদানের সম্ভাষণ ও সম্প্রসারণ কবি প্রত্যেক বইতে নতুন চেহারায় তো হাজির হচ্ছেন না! আর এই কারণেই কালীকৃষ্ণ গুহ প্রশ্নাতীতভাবে সন্দেহের ঊর্ধে চলে যান। বানিয়ে তোলা খেলার করণ কৌশলের বাইরে,  মেকি কাব্য ছাঁদের বহির্দেশে নিজেকে স্থাপিত করেন, কেননা একটি চারাগাছ বেড়ে ওঠার মতোই ধীরে ধীরে বদলায় তার কাব্যভাষা ও চেতনা। এক বই থেকে পরবর্তী বইয়ে ফারাক সূক্ষাতিসূক্ষ, যেভাবে বুধবারের গাছ আর শুক্রবারে তার চেহারার ফারাক প্রায় অদৃশ্য রূপে সূক্ষ। অথচ সময় বদলে যাওয়ার সাথে সাথে দীর্ঘকালের প্রেক্ষাপটে, বিবর্তনের রূপ তার ধারাবাহিকতা নিয়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবি তো নিজেকে পালটে পালটে খেলার সাধনা করেন না বরং দ্রুত পালটে যাওয়া ঘটনাবলির কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সাধারণ্যে স্থির সার্বভৌম্য এক আত্ম-এর উন্মেষ ঘটান। আত্মবিবর্তনের ধারাপাতে নিজস্ব সমৃদ্ধিতে তাই বদলে যাওয়ার ইতিহাসও পরিলক্ষিত হয় “micro” পর্যায়, হয়ত সে কারণেই ব্যক্তি কালীকৃষ্ণ, দিনাতিদিনের কালীকৃষ্ণ এবং কবি কালীকৃষ্ণ-র টানাপোড়েন থাওলেও বিভেদ নেই। উপরন্তু সম্পূর্ণ চেহারাটাই এক সামগ্রিকতায় ধরা থাকে।

“রক্তাত্ব বেদীর পাশে” কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাতে উনি লিখেছিলেন, “ যেহেতু নিজেকে অস্বীকার করতে পারি না, তাই ক্ষমা করে নিতে হল”। আসলে এই ক্ষমাধর্মের মধ্যে দিয়ে অহং নাশ হয়ে যে আত্মরূপের প্রতিষ্ঠা হয়, সে নিয়ে আসে “অনুভূতি দেশ থেকে আলো”। আমাদের হৃদয়কে সে করে তোলে রূপবান আর রূপবান সেই হৃদয় সীমার বাইরে গিয়ে আরাধ্য করতে চায় এক অরূপ অদৃশ্য অশেষকে। জীবন ,মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শেষ হয় অথচ ক্রিয়াগত চৈতন্য অশেষের পিছু ছাড়ে না, যেমন আমাদের পিছুটান থেকে যায়, না হওয়া কবিতাগুলির প্রতি, যেমন পিছুটান থেকে যায়, হয়ে ওঠা কবিতার কাছে বারবার ফিরে গিয়ে, আঁশের মধ্যে থেকে বীজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায়।

এইসব চেষ্টাগুলি এক্ষেত্রে পাঠকদের সম্পদ আর কবি হিসেবে কালীকৃষ্ণ গুহ-র বারবার, বহুবার পঠিত হওয়ার ধ্রুব-ধ্বংসের কারনামা।






আকাশপ্রদীপ

‘ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালেবিলে’ –
কেন বাজায় কেউ জানে না তা
কারা শোনে কে দেয় হাততালি?
উত্তর নেই – উড়ছে বটপাতা।

এই কথাটা নিয়ে কবির কবি
অনেক কথা ভেবেছিলেন মনে –
কতকালের অবাক-করা কথা
সময় বহন করছে নির্জনে।

মাঠের পাশে একলা একটা বুড়ি
চাটাই বোনে, এই শুধু কাজ তার
ডাকাত দলে হরণ করল মেয়ে
দুঃসহ সেই স্মৃতির অধিকার।

বুকফাটা এক দুঃখ আছে ঢাকা
কথার মধ্যে ভাষার ছন্দ-মিলে
আকাশপ্রদীপ জ্বলছে দৃশ্যাতীতে
ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালেবিলে।


তর্ক

ঘরের ভিতরে খুব তর্ক চলে। অন্ধকার ঘর।
কেন বেঁচে থাকবো যদি বেঁচে থাকা অর্থহীন হবে, এই তর্কের বিষয়।
অনস্তিত্ব থেকে জাত যে শুদ্ধতা তার থেকে এই বিশ্ব ভুলভাবে ছিটকে বেরিয়েছে—
পল ভালেরির এই উক্তিটিকে ঘিরে তর্ক শুরু হয়েছিল দু’দশক আগে।
তখন চায়ের সঙ্গে রেস্তরাঁয় কাটলেট আসতো মাঝে মাঝে।
কিন্তু তর্ক আজ অন্ধকার ঘরে।
কোনো এক জটিল মুহূর্তে আমি এই তর্ক থেকে ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে
বাইরে বেরিয়ে আসি। দেখি :
শিশুরা পার্কে যাচ্ছে— তাদের দিদিরা ডানা মেলে ভেসে যাচ্ছে এক ছাদ থেকে
অন্য ছাদে।


আবহমান

আমাদের কথা শেষ হল বৃষ্টিতে
বৃষ্টি-বিধুর গান তো হল না গাওয়া
স্মৃতি থেকে আজ কত মেঘ উড়ে এল
তবু, বস্তুত, নিকটে হল না যাওয়া।

একটি তারার নাক্ষত্রিক আলো
জীবনে ছড়ায় কিছু রহস্য, ভাষা
এই নিয়ে বাঁচা মরু-শহরের দেশে
ক্ষয় থেকে তবু জেগে ওঠে প্রত্যাশা।

বহু অতীতের বহু পুরাণের মানে
না বুঝে মানুষ নিজের নারীকে ঘিরে
রয়ে গেছে স্থির নীল শিশুদের ভিড়ে
কান্নার শেষে, রাত্রির অবসানে।

আমিও জেনেছি বহু অপমানে জ্বরে
ভুগে উঠে শেষে আকাশের দিকে চাওয়া
অদ্ভুত লাগে; মনে হয় একা হেঁটে
সব থেকে ভালো জন্মের দিকে যাওয়া।